Thursday, December 3rd, 2015




আওয়ামী লীগ-বিএনপির ‘মনোনয়ন বাণিজ্য

awl-bnp-2015_17372
পৌরসভার মেয়র প্রার্থী চূড়ান্ত করতে প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে দুটি সিন্ডিকেটেরে প্রভাব কাজ করেছে বলে অভিযোগ বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীর। আওয়ামী লীগের এ সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিয়েছেন সাবেক এক প্রতিমন্ত্রী। অন্যদিকে নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পাঁচ শীর্ষ নেতা যৌথভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছেন বিএনপির মনোনয়ন। দু’দলের সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধেই ‘মনোনয়ন বাণিজ্য’র অভিযোগ উঠেছে। লেনদেন হয়েছে মোটা অংকের অর্থের। এতে মনোনয়ন পেতে ব্যর্থ হয়েছেন ত্যাগী, জনপ্রিয় ও দলের প্রতি নিবেদিত উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নেতা। আর মনোনয়ন বাগিয়ে নিয়েছেন বিতর্কিত ব্যক্তিরা। এমনকি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হত্যা মামলার এক নম্বর আসামির ভাই ও যুদ্ধাপরাধী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের আইনজীবীর ভাই। পাশাপাশি বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার আসামিও। সিন্ডিকেটকে ‘ম্যানেজ’ করে যেসব অযোগ্যরা মনোনয়ন পেয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই বিদ্রোহী প্রার্থী থাকবেন। এক্ষেত্রে দু’দলই ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আশংকা নেতাকর্মীদের। এসব অনিয়মের বিষয় টের পাওয়ার সংশ্লিষ্ট নেতাদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। পরিস্থিতি সামাল দিতে তাৎক্ষণিভাবে প্রার্থী তালিকা থেকে বেশ কয়েকজনকে বাদ দিয়ে নতুন নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন তারা। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে এসব তথ্য

 আওয়ামী লীগ : আওয়ামী লীগ পৌরসভার মেয়র পদে প্রার্থী মনোনয়নে একাধিক জরিপের সাহায্য নিয়েছে। এ কারণে প্রায় শতাধিক পৌরসভায় একক প্রার্থী মনোনয়ন দেয়ার সুপারিশ এলেও ঢাকায় এসে বেশ কিছু নাম উল্টে গেছে। সুপারিশকৃত তালিকার বাইরে থেকেও মেয়র পদে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। আবার মেয়র পদে ব্যাপক মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ এসেছে। অর্থের বিনিময়ে দলীয় মনোনয়ন পাইয়ে দেয়ার বিষয়টি এখন সারা দেশে শাসক দলের নেতাদের মুখে মুখে। জেলা ও বিভাগীয় এমনকি কেন্দ্রের দু-একজন প্রভাবশালী নেতার বিরুদ্ধে অর্থ-বাণিজ্যের জোরালো অভিযোগ উঠেছে। এ ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারী নেতা হিসেবে একাধিক এমপি ও নেতার নাম এখন মুখে মুখে।
 সোম ও মঙ্গলবার দু’দফা মনোনয়ন বোর্ডের বৈঠকে সারা দেশে ২৩৫ পৌরসভায় মেয়র পদে প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়। এসব পৌরসভায় মেয়র প্রার্থী চূড়ান্ত করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যরা দু’দিন বৈঠক করেন। এ বৈঠকে দক্ষিণাঞ্চলের একজন সিনিয়র নেতা ও মন্ত্রী তার নিজ জেলার পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে কথা বলতে গিয়ে দলের সভানেত্রী ও প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরাগভাজন হন। আরেকজন নেতা তার জেলা সদরে একজন প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নিলে প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হন। তিনজন মনোনয়ন প্রত্যাশীর পক্ষে একজন সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমানে এমপি শক্ত অবস্থান নিলে তারা চূড়ান্তভাবে মনোনীত হন। একপর্যায়ে ওই সাবেক মন্ত্রীর উদ্দেশে মনোনয়ন বোর্ডের এক সদস্য বলেন, তিনটি তো হল আপনার কি আরও লাগবে?
 নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের এক সদস্য যুগান্তরকে বলেন, ২৩৫ পৌরসভার মধ্যে শতাধিক পৌরসভায় মেয়র পদে মনোনয়নের জন্য একজন করে নাম প্রস্তাব করা হয়। তাদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি চূড়ান্তভাবে মনোনীত হন। বাকিগুলো পরিবর্তন করা হয়। দলীয়ভাবে এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার করা জরিপের রিপোর্টের সঙ্গে মিলিয়ে এ পরিবর্তন আনা হয়েছে বলে সূত্রটি জানায়। আবার প্রস্তাবিত তালিকায় নাম না থাকলেও জরিপ রিপোর্ট দেখে প্রার্থী চূড়ান্ত করার মতো ঘটনাও ঘটেছে।
 সূত্র জানায়, নাটোর থেকে পাঠানো দলের তালিকায় নাম ছিল না সদর পৌরসভার সম্ভাব্য প্রার্থী জলি চৌধুরীর। তার বদলে সেখান থেকে একক নাম আসে বর্তমান এমপি শফিকুল ইসলাম শিমুলের বোনজামাই বুড়া চৌধুরীর। মনোনয়ন বোর্ড বুড়া চৌধুরীকে বাদ দিয়ে জলি চৌধুরীকে চূড়ান্তভাবে মনোনীত করে। জলি চৌধুরী নাটোরের সাবেক এমপি প্রয়াত শংকর গোবিন্দ চৌধুরীর মেয়ে।
 একই ঘটনা ঘটেছে রাজশাহীর চারঘাট পৌরসভার ক্ষেত্রেও। সেখানে মনোনয়ন পাওয়া নার্গিস বেগমের নাম ছিল না তৃণমূলের প্রস্তাবিত তালিকায়। কিন্তু মনোনয়ন বোর্ড জরিপ রিপোর্টের ভিত্তিতে মনোনয়ন পেয়েছেন ওই আসনের সাবেক এমপি এবং রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি রায়হানুল হক রায়হানের স্ত্রী নার্গিস বেগম। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে তৃণমূল থেকে কারিবুল হক রাজিনের নাম পাঠানো হলেও তা পরিবর্তন করে দেয়া হয়েছে মঈন খান নামে একজন আওয়ামী লীগের নিষ্ক্রিয় কর্মীকে। রাজশাহীর কাটাখালীতে মনোনয়ন পেয়েছেন যুবলীগ থেকে দু’বার বহিষ্কৃত আব্বাস আলী। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শিক্ষক, অধ্যাপক একেএম শফিউল আলম লিলন হত্যা মামলার এক নম্বর আসামির ভাই।
 শিবগঞ্জ ও কাটাখালীতে মনোনয়নপ্রাপ্ত এ দু’জনের জন্য আওয়ামী লীগ নেতা খায়রুজ্জামান লিটন তদবির করেন বলে দলটির স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা অভিযোগ করেছেন। এক্ষেত্রে বিপুল আর্থিক লেনদেনের কথা এখন সেখানকার মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। তারা বলছেন, আওয়ামী লীগের একজন উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও মন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক প্রতিমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেট মনোনয়নের জন্য তদবির করেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরে মনোনয়ন পাওয়া সামিউল হক লিটনও একই কায়দায় মনোনয়ন পেয়েছেন বলে স্থানীয় নেতাকর্মীদের অভিযোগ।
 চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ পৌরসভায় মনোয়নবঞ্চিত কারিবুল হক রাজিন যুগান্তরকে বলেন, তৃণমূল নেতাকর্মীরা তাকে মনোয়ন দেয়ার সুপারিশ করেছিলেন। যাকে দেয়া হয়েছে, তার নিশ্চিত ভরাডুবি ঘটবে।
 বিএনপি : আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনে প্রার্থী চূড়ান্ত করা নিয়ে নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠেছে। আর্থিক লেনদেন এবং নানামুখী প্রলোভনে অনেক পৌরসভায় বিএনপির অযোগ্য ও সুবিধাভোগীরা দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার চার্জশিটভুক্ত আসামির হাতেও ধানের শীষের প্রতীক তুলে দেয়া হয়েছে। অনেক জায়গায় তৃণমূলের মতামতকে তোয়াক্কা করা হয়নি। বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে দেখা যায়নি এমন অনেকেও দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। মনোনয়ন চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে নানা অনিয়মের কারণে যোগ্য ও ত্যাগীরা বাদ পড়ায় চরম ভরাডুবির আশংকা করছেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা। মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার পর থেকেই বিদ্রোহ ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
 বুধবার গুলশান কার্যালয়েই মনোনয়ন নিতে আসা প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটে। বিগত আন্দোলনে যারা রাজপথে ছিলেন না এমন অনেক কেন্দ্রীয় এবং জেলা নেতা তাদের সমর্থিত প্রার্থীদের পক্ষে সুপারিশ করতে গুলশান কার্যালয়ে গত কয়েকদিন ধরেই ভিড় করছেন। তারা দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে নিজ সমর্থকের মনোনয়ন নিশ্চিত করার চেষ্টা করেন। কেউ কেউ সফলও হন। অপরদিকে অযোগ্য ও ব্যর্থদের যাতে মনোনয়ন না দিতে পারে এজন্য তৃণমূলের অনেক নেতা দায়িত্বপ্রাপ্তদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগই পাননি। গুলশান কার্যালয় এমনকি ওই নেতাদের বাসা পর্যন্ত গেলেও তাদের সাক্ষাৎ মেলেনি। ক্ষোভ এবং হতাশা নিয়ে অনেকেই এলাকায় ফিরে যান।
 জানতে চাইলে শিবচর উপজেলা বিএনপির সভাপতি নাজমুল হুদা চৌধুরী (মিঠু) যুগান্তরকে বলেন, শিবচর পৌরসভায় দলের চেয়ারপারসনের গাড়িবহরে হামলার আসামিকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। বিষয়টি জানানোর জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইলে তারা সময়ই দেননি। ক্ষোভ এবং হতাশা নিয়েই এলাকায় ফিরে যাচ্ছি।
 সূত্র জানায়, দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করতে কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো মনোনয়ন বোর্ড গঠন করেনি বিএনপি। প্রার্থী চূড়ান্ত করতে কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতাকে দায়িত্ব দেয়া হয়। পৌরসভা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগ থেকেই দফতরের মাধ্যমে সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম সংগ্রহ করা হয়। নিয়ম রক্ষায় জেলা কমিটি, স্থানীয় সাবেক সংসদ সদস্যদের কাছ থেকে সম্ভাব্য তালিকা নেয়া হয়। কিন্তু প্রার্থী চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে তৃণমূলের সুপারিশকে তোয়াক্কা করা হয়নি। কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতা সারা দেশে তাদের সিন্ডিকেটের লোকজনকে প্রার্থী করার মিশন নিয়ে নামেন। দলের চেয়ারপারসনকে নানাভাবে বুঝিয়ে তাদের ইচ্ছামতো মনোনয়ন চূড়ান্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু এরই মধ্যে নানা জায়গা থেকে খালেদা জিয়ার কাছে নানা অভিযোগ আসতে থাকে। বিষয়টি নিয়ে ৩ দিন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের ডেকে কথা বলেন খালেদা জিয়া। গুলশানের বাসায় গভীর রাত পর্যন্ত তিনি প্রার্থী চূড়ান্ত করার কাজ করেন। খালেদা জিয়ার নির্দেশে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা অনেক প্রার্থীর নাম পরিবর্তন করতে বাধ্য হন। নানা জায়গা থেকে অভিযোগ আসার কারণেই প্রার্থী চূড়ান্ত করতে বিলম্ব হয়। যেসব এলাকায় তারা শক্ত বাধার মুখে পড়েছেন সেখানে প্রার্থী পরিবর্তন করা হয়। কিন্তু অনেক পৌরসভায় স্থানীয় নেতারা অভিযোগ করেও তা পরিবর্তন করতে পারেননি। অযোগ্যদের মনোনয়ন দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক আর্থিক লেনদেন হয়েছে বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তৃণমূলের একাধিক নেতা যুগান্তরকে জানান।
 প্রার্থী চূড়ান্ত করতে বিলম্ব হওয়ার নানা কারণ উল্লেখ করে সংশ্লিষ্টরা জানান, কোথাও কোথাও মামলা ও গণগ্রেফতারের কারণে যোগ্য প্রার্থীর সংকট দেখা দেয়। আবার কোথাও কোথাও একাধিক যোগ্য প্রার্থী ছিলেন। এর সঙ্গে ছিল নানা লবিং ও তদবির। তাই নানামুখী তৎপরতায় বারবার কাটছাঁট করা হচ্ছে খসড়া তালিকা। তবে যেসব পৌরসভায় বিদ্রোহ বা মামলার ঝামেলা নেই সেখানে আগেই প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়েছে।
 চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার এক নেতা নাম না প্রকাশ করার শর্তে  বলেন, আমরা জেলা থেকে চার পৌরসভার জন্য চারজনের নাম প্রস্তাব করেছিলাম। কিন্তু কেন্দ্র সেই তালিকা থেকে একজনকে বাদ দিয়ে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়েছে। যার এলাকায় কোনো জনসমর্থন নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category